।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নৈশ প্রহরী
-রাণা চ্যাটার্জী
‘..কইগো ওঠো বাজার যাও পরশু জামাইষষ্ঠী, আর তোমার কোন হেলদোল নেই:!..ইয়ে মানে বলে প্রমথ জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নায় নিজের চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে নিজেই চমকে উঠল।
ভালো সম্বন্ধ, ফেলে দেওয়া যায় না, মেয়ে রাজরানী হবে- চাপের মুখে পড়ে কয়েক লাখ টাকা পার্সোনাল লোনের বোঝায় কলেজ ছাত্রী মেয়েটার বিয়ে দিয়ে থেকে ওষ্ঠাগত প্রাণ!কাকে আর বলবে, তার সহধর্মিনীকে? সে তো প্রতিমুহূর্তে ত্যাগ স্বীকার করেই চলেছে। দুশ্চিন্তায় প্রেসার সুগার বাড়লে প্রমথের বিপদ উল্টে বাড়বে।
সমস্যা যতই থাক প্রথমবার জামাইষষ্ঠী বলে কথা, ভালো আয়োজন, উপহার সামগ্রী না দিলে সত্যি মান থাকে না । আরও একবার ফোন করে নিল মেয়েকে।” মিষ্টি মা আমার, তোর শাশুড়ি মাকে বলেছি, সকাল সকাল চলে আসিস কাল কেমন”।
“তোমায় একটা কথা বলবো মা,বলো কাউকে বলবে না। বলছি একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেবে কাল”? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো শর্মিলার,:কেন তোদের অত বড় গাড়িটা কি হলো’?
“..আসলে মা,ওটা নিয়ে বেরুলে মিনিমাম দুহাজার টাকার তেল ভরতে হবে, ড্রাইভার ,টোল ট্যাক্স সহ আরও খরচ ! কি বলবো তোমায় ,লকডাউনে ওর চাকরিটা চলে গেছে মা!গাড়িটা খারাপ এটাই কিন্তু বলবে বাবাকে, নইলে সন্দেহ করবে”।
কই গো শোনো না এই প্রথম বছর মেয়ে -জামাই,, ষষ্ঠী করতে আসছে আমাদের বাড়ি,একটা মান সম্মান আছে তো নাকি নিজেদের, তাই বলছি পটাই কে বলো কাল যেন একটা গাড়ি ব্যবস্থা করে দিদি জামাইবাবু কে নিয়ে আসে ।
বলো কি গো,আমাদের কে তাবলে গাড়ি পাঠাতে হবে!?চোখ পাকিয়ে উঠলো শর্মিলা,” হ্যাঁ হবে,হবে তোমার মতো কে আছে যে একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে যখন খুশি শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়া!আহা হা গিন্নি তুমি তো জানো,উপার্জনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে মিষ্টির বিয়ের ঋণের সুদ গুণতে,বলতে গিয়েও না বলে শ্বাস নিয়ে বললো,চিন্তা করো না,দেখছি কি করা যায়।
জামাই ষষ্ঠী ভালোভাবেই মিটলো কিন্তু কিছুতেই ওরা ফেরার নাম উচ্চারণ করছে না।ওয়ার্ক ফ্রম হোম বাহানা দিয়ে সেই যে জামাই তিনতলার ঘরে ঢুকেছে!মেয়ে আর গিন্নি খাবার জল পৌঁছে দিয়ে আসছে সময়ে সময়ে।
“বাবাজীবন বলছিলাম শরীর ঠিক আছে তো তোমার?এসে থেকে বড্ড চুপ দেখছি কিনা”।প্রমথ প্রথম থেকেই একটু নিজেকে গুটিয়ে রাখতো আসলে সে নিজে একটা ছোট খাটো কাজ করে কিনা!বিয়ের সময় এমন একটা কথা ওর কানে এসেছিল, নামি কোম্পানির উঁচু পোস্টে কর্মরত জামাই নাকি শ্বশুরের সামান্য কাজ নিয়ে নাক সিঁটকে ছিল, মেয়ে কে ও কটাক্ষ করতে ছাড়ে নি!
কই গো ঘুমালে নাকি!শর্মিলা হালকা গুঁতো দিয়ে স্বামীকে কিছু বলতে গিয়ে বিছানা খালি দেখে চমকে উঠেছে। কি ব্যাপার তবে কি বাথরুম গেলো নাকি!কি যেন একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো তার অমনি জামাই- মেয়েকে নিয়ে চিন্তা আসছিল।সে তো হলো কিন্তু এমন গভীর রাতে স্বামী গেলো কোথায়!!অপেক্ষা করতে করতে ওষুধের প্রভাবে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল শর্মিলা। যখন ঘুম ভাঙলো প্রায় সাতটা।প্রমথ পাশে ঘুমাচ্ছে দেখে অবাক হয়ে ভাবলো তবে কি সে কাল স্বপ্ন দেখেছে!! কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।প্রতিদিনের মতো উঠে ঠাকুরের ফুল তুলে চা বানিয়ে স্বামীকে উঠিয়ে কথাটা তুললো। “জানো কাল স্বপ্নে দেখি তুমি পাশে নেই”। চোখ কপালে তুলে মুচকি হেসে প্রমথ উত্তর দিলো,”নেই মানে কি গো গিন্নি, আমি তো সব সময়ই পাশে তোমার”।
আরে না না সেই পাশে থাকা বলছি না, কাল রাতে দেখি পাশে শুয়ে নেই,কিন্তু ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।রাত জাগা ক্লান্তির হাই তুলে বললো প্রমথ তুমি যেমন তোমার জামাইয়ের বিষয়ে আমায় আড়াল রেখেছো কিন্তু আমি সব বুঝতে পারি বুঝলে তাই রাতে একটা পার্ট টাইম জব নিলাম।বিস্ময়ে শর্মিলার চোখে জল,এই তুমি কি সব বলছো গো,এই বয়সে আবার রাত জেগে কাজ করে মরবে নাকি??
নাগো সেসব কিচ্ছু হবে না,আমি ঠিক সামলে নেবো,সংসারের যা খরচ বাড়ছে তারপর মেয়েটা..: বলে চোখ ছল ছল হলো প্রমথের। বাক রুদ্ধ শর্মিলা তখনো অবাক হয়ে পাশে! ওর এমন ঘোর ভাঙিয়ে প্রমথ বললো “হ্যাঁ গো একদম ঠিক বলছি শর্মিলা, ওই মোড়ের মাথায় যে এটিএম টা আছে ওখানে বিজ্ঞাপন দেখে আমি ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করি।ওরা আমায় নৈশ প্রহরী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেখবে দাঁড়াও বলে দরজার পেছনে ঝোলানো ব্যাগ থেকে আই কার্ড বের করে হাতে দিলো শর্মিলার ।আক্সিস ব্যাঙ্ক লেখা নিরাপত্তা রক্ষীর অস্থায়ী জব লেখা একটা আই কার্ড সঙ্গে জীবনে হার না মানা হাসি মুখের ছবি “প্রমথ গাঙ্গুলী”। প্রমথ তখনো বলে চলেছে ,”ডিউটি টাইম রাত বারোটা থেকে সাড়ে পাঁচটা”।শর্মিলার চোখ থেকে বাঁধ না মানা জল ঝরে পড়লো।”কাঁদে না শর্মিলা, আমরা যদি কাঁদি আমাদের সন্তানরা কিভাবে ভরসা পাবে বলো!